নির্ভুল বার্তা ডেস্কঃ
করোনাভাইরাস যেদিন থেকে তার ‘কার্যক্রম’ শুরু করেছে, সেদিন থেকে কোনো দিন ছুটি নেয়নি। তাই স্থানবিশেষে কেবল কমেছে-বেড়েছে, কিন্তু মোটেও ছেড়ে যায়নি। তবে আমরা তার উপস্থিতিতে এক লম্বা ঈদের ছুটি নিয়ে নিলাম। ছুটিটা এমন যে বাড়ি যাওয়া, পশু কেনাবেচার জন্য দীর্ঘ সাত দিন দেওয়া হলেও আর সব সামলে ফিরে আসার জন্য দেওয়া হলো মাত্র একটি দিন। মোবাইল অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, এক কোটির বেশিসংখ্যক মানুষ রাজধানী ছেড়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এক দিনে এর তুলনায় অত্যন্ত কমসংখ্যক মানুষ কর্মস্থলে ফিরে আসতে পেরেছেন।
মানুষের ধর্মীয় উৎসব পালন জরুরি, উৎসবে শিকড়ের কাছে ফেরাও জরুরি, কিন্তু সবকিছুতে উপস্থিত থেকে আবার কর্মস্থলে নিরাপদে ফেরাটাও কম জরুরি নয়। করোনাভাইরাসের ছোবল ক্রমাগত বাড়তে থাকার মুহূর্তে স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষক ও বিজ্ঞজনেরা বিপুলসংখ্যক মানুষের দীর্ঘ যাত্রা ও স্থান পরিবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু এদিকে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজন অগ্রাহ্য করে মানুষের স্থানান্তর ও ধর্মীয় উৎসব পালন ও এ-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে কর্মস্থল থেকে মানুষের বাড়ি পৌঁছানোর তুলনায় ফিরে আসার ব্যাপারে সরকার বাস্তব তেমন ব্যবস্থা নেয়নি।বিজ্ঞাপন
সত্যিকারভাবে, মানুষ উৎসবের কারণে কর্মস্থল থেকে বাড়ি পৌঁছে যাবেন আর পরবর্তী দুই সপ্তাহ বা পরিস্থিতি বিশেষে এরও বেশি সময় সেখানেই অবস্থান করবেন, এ রকম ধারণা করা অবান্তর। দীর্ঘ ছয়-সাত দিনব্যাপী যে মানুষ ঢাকা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছেছেন, মাত্র এক দিনের মধ্যে রাস্তায় নেমে তাঁরা কোনো না কোনো পরিবহনব্যবস্থা গ্রহণ করে ফিরে আসবেন, এটাও বাস্তবে অসম্ভব। বস্তুত এতগুলো মানুষকে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ফিরতে হলে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা পাঁচ-ছয় গুণ হতে হতো। আর সে রকম সম্ভব হলেও দীর্ঘ যানজটে তাঁরা সরকারের বাঁধাধরা সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হতেন। তাই মূলত এ সিদ্ধান্ত ছিল বাস্তববিবর্জিত ও সিদ্ধান্তটির মাধ্যমে সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ বরং না মানতে জনগণকে উৎসাহিত বা বাধ্য করা হয়েছে।বিজ্ঞাপন
আগের ঈদে দেখা গেছে, গণপরিবহনব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ। সাধারণ মানুষকে নানা রকমের ভোগান্তির মধ্যে ফেলে তখন কেবল ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদের উৎসব উপলক্ষে বাড়ি যাওয়াকে সহজ করা হয়েছিল। তখন সাধারণ মানুষের অনেকে পরিবহনের সুবিধাবঞ্চিত হয়ে অনেক বেশি ভাড়ায় কারও ব্যক্তিগত গাড়িতে কিংবা অন্য নানান উপায়ে, এমনকি মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফলে তাঁরা অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন। মাত্র আড়াই মাসের মাথায় সরকার তাঁদের আরেকভাবে একই রকমের ভোগান্তিতে পড়তে বাধ্য করল। ঈদ উৎসব স্বাভাবিক সময়ের মতো করে উদ্যাপনের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল, বস্তুত তা গ্রহণ করা হয়নি।
মূলত এখন স্বাভাবিক সময় নয়। তাই এখন প্রয়োজন ছিল সতর্কতার। প্রায় প্রতিদিন আগের রেকর্ড ছাপিয়ে সংক্রমণ যেখানে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে একই দিনে বহু মানুষকে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হয়েছে, গাদাগাদি করে অপ্রতুল লঞ্চ ও বাসে চড়তে হয়েছে। মানুষের ভোগান্তির মাত্রা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। হাজার হাজার মানুষ শিশু, ভারী ব্যাগ, অন্যান্য জিনিসসহ পরিবহনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় অপেক্ষা করেছে। এতে করে বহুসংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণসহ নানাবিধ অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।
আমাদের মতো দেশে বিধিনিষেধ দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না, এর অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই সরকারের হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কোভিড সম্পর্কে সতর্কতা তৈরি, যথাসম্ভব অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করা ও চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি সরকারের মনোযোগের কেন্দ্র হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাপকসংখ্যক মানুষ যখন ঢাকার বাইরে চলে গেল, তখন বলা বাহুল্য, সংক্রমণও হটস্পট রাজধানী থেকে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন কোণে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। পরিতাপের বিষয় হলো, রাজধানী থেকে দূরদূরান্তের শহরগুলোতে আইসিইউ না থাকা কিংবা থাকলেও আসনস্বল্পতা ভয়াবহ সমস্যা। বেশির ভাগ স্থানে উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। এ রকম অবস্থার মধ্যে যাঁরা রাজধানীর বাইরে চলে গেলেন, কিন্তু সরকারের নীতি ও অপরিকল্পিত ব্যবস্থার কারণে ফিরতে পারলেন না, তাঁদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ তো হলোই, তাঁদের মাধ্যমে স্থানীয় যাঁরা সংক্রমিত হবেন, তাঁরাও বিপদগ্রস্ত হলেন।
অন্যদিকে মানুষকে খাদ্য সরবরাহ না করে যে কোনোমতেই বিধিনিষেধ সফল করা যাবে না, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সেদিকে খেয়াল না দিয়ে এককভাবে কর্মস্থল থেকে দূরে সরিয়ে বিধিনিষেধের ব্যবস্থা মোটেও কারও জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
যেখানে মানুষকে কোভিডকেন্দ্রিক সতর্কতার আওতায় আনা, আরও বেশি পরীক্ষার সুবিধা, আক্রান্তের ক্ষেত্রে চিকিৎসাসুবিধা, টিকা সংগ্রহ ও প্রদানের ব্যবস্থার বিষয়ে দেশব্যাপী ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে দ্রুত মনোনিবেশ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই, সেখানে তাঁদের আরও বেশি বিপদে ফেলার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত ভালো ফল বয়ে আনবে না। মানুষের যেমন সচেতনতার মাধ্যমে সুস্থ থাকার প্রয়োজন আছে, তেমনি চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারও আছে। বিধিনিষেধের মাধ্যমে তাঁদের বিভিন্ন স্থানে আটকে রাখলেই তাঁরা সচেতন হয়ে উঠবেন না। বরং চিকিৎসাসুবিধার অভাবে তাঁরা নানা রকমের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসবেন, যাতে তাঁদের ভোগান্তি আরও বাড়বে। অন্যদিকে সরকারকে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা যেমন নিশ্চিত করতে হয়, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর ব্যবস্থাও করতে হয়। সরকার দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা ভেবে যদি মানুষের স্থানান্তরে বিধিনিষেধ শিথিল করে, তবে তা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিণতির দিকে আনা প্রয়োজন ছিল। কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে উঠে আসা মানুষের ভোগান্তির কাহিনি, ছবি ও ভিডিও কেবল দুর্বল ও ভুল পরিকল্পনার প্রমাণ দেয়।বিজ্ঞাপন
বাস্তবে যে রকম কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে এবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়োজিত থাকতে দেখা যাচ্ছে, তাতে করে এটুকু নিশ্চিত বলা যায়, ভোগান্তি কাঁধে নিয়ে প্রচুর মানুষ ফিরলেও বাকিরা কর্মস্থল থেকে দূরে থাকার পরিকল্পনা বেছে নিতে বাধ্য হবেন। মোবাইল কোম্পানিগুলো সিম ট্র্যাক করে অধিকসংখ্যক মানুষের না ফেরার ব্যাপারে তথ্য সরবরাহ করেছে। ওদিকে ঈদের ছুটির কিছু আগে থেকেই দেশে ডেলটা ভেরিয়েন্টসহ আরও নতুন কিছু ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার কারণে জেলা শহরগুলোতে সংক্রমণের হার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েক দিনে অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেছে। বাস্তবে রাজধানীতেই একটি আইসিইউ বেডের জন্য মানুষ হন্যে হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘোরে। কখনো হাসপাতালে কোভিড রোগীর একটি সিটও জোটে না। সে জায়গায় জেলা হাসপাতালগুলো কোভিডে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা সরবরাহ করতে আরও বেশি ব্যর্থ হবে। বস্তুত সার্বিক কাঠামোগত উন্নয়নের আগে দেশব্যাপী চিকিৎসা কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
করোনাকাল প্রায় দেড় বছর হতে চললেও গ্রামে–গঞ্জে উপযুক্ত কোভিড চিকিৎসা দেওয়ার মতো দৃশ্যমান পরিবর্তন আসেনি। তাই চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে না গিয়ে এত মানুষকে গ্রামে ও ছোট শহরে যেতে দিয়ে এই যে আটকে ফেলা হলো, এই আচরণ নেহাত অমানবিক। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের যেখানে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার আছে, সেখানে পরিস্থিতির শিকার হিসেবে আগেই জনগণকে ভাগাভাগি করে ফেলা হলো। বর্তমান অবস্থায় কেউ উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ পেলে পেতেও পারেন, তবে কেউ যে পাবেন না, তা নিশ্চিত। বহু অসুস্থ মানুষ অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় আসার সংগতি রাখে না। অনেকের হয়তো সংগতি থাকলেও রোগের মাত্রা তাকে সেই সুযোগ দেবে না, সময়মতো একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হবে কি না, এ ধরনের অনেক অনিশ্চয়তা সামনে এসে পড়বে।বিজ্ঞাপন
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার সংকুলান না করে মানুষের স্থানান্তর একদিকে যেমন সমস্যার সৃষ্টি করেছে, আরেক দিকে ৩০ জুলাই স্বাস্থ্যসেবা গবেষকদের পক্ষ থেকে স্থানান্তর ও জরুরি সেবা ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার অনুরোধ আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরকারের তরফ থেকে দেশব্যাপী তৈরি পোশাক কারখানা খোলার ঘোষণা এসেছে। পোশাক কারখানার মালিকদের উপর্যুপরি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়, যা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর পক্ষে অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু অন্যদিকে, দেশব্যাপী পরিবহন বন্ধের সময়ে যে শ্রমিকদের একটানা ঈদের ছুটি ও বিধিনিষেধ দিয়ে স্থানান্তর করা হয়েছিল, তঁারা কী উপায়ে কর্মস্থলে ফিরবেন, এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
পরিবহন আবার চালু না করে সিংহভাগ শ্রমিকের কর্মস্থল পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ায় যে বিধিনিষেধের নিয়ম ভেঙে মহাসড়কে দীর্ঘ পথ পায়ে চলা শ্রমিকদের ঢল নামবে, এ বিষয়ে সরকারের অবশ্যই ওয়াকিবহাল থাকা উচিত। কারখানার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে পয়লা আগস্ট থেকে যোগদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ৪ ও ৫ এপ্রিল ঠিক একই রকমের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কারণে হাজার হাজার শ্রমিক শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। অত্যন্ত দুঃখজনক যে তাঁদের কারখানার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে একইভাবে হেঁটে বাড়ি ফিরতেও হয়েছিল কারখানা আবারও বন্ধ হয়ে যাওয়ার তড়িৎ সিদ্ধান্তের কারণে। চলমান দুঃসহ সময়ে সরকার ও কর্তৃপক্ষের এমন অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের কেবল ভোগান্তিই বাড়ে। যে শ্রমিকদের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আসে, তঁাদের পরিকল্পিত উপায়ে হয়রান করা ও স্বাস্থ্যগত সমস্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার নিষ্ঠুরতা সরকারের কাছে কাম্য নয়।
মানুষের স্থানান্তর সংক্রমণ যেমন বাড়িয়েছে, এসব অসুবিধা দেশে করোনাজনিত মৃত্যু আরও বাড়াবে, এতে সন্দেহ নেই। তাই কেবল করোনা নয়, অদূরদর্শী পরিকল্পনাও বহু মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবে।