দৈনিক নির্ভুল বার্তা ডেস্কঃ
মাদারীপুরের শিবচরের কাঠালবাড়ি থেকে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের চরসেনসাস পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার পদ্মা নদী। এই ৫৫ কিলোমিটারই গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের নৌ যাতায়াত হয় এ পথ ধরে। কিন্তু পদ্মা নদীর এ এলাকাজুড়ে কয়েক শ অবৈধ বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল করে। যার অধিংকাশেই অবৈধভাবে তোলা বালু পরিবহন করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা নদী ঘিরে এ বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। অবৈধ বালু উত্তোলন ও অনুমোদনহীন বাল্কহেড বন্ধ করতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
গতকাল সোমবার মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌপথের কাঠালবাড়ি এলাকায় বালুবোঝাই একটি বাল্কহেডে ধাক্কা লেগে ২৬ যাত্রী মারা গেছেন। এর আগে ৫ এপ্রিল নড়িয়ায় দুটি বাল্কহেডে ধাক্কা লেগে এক শ্রমিক মারা গেছেন। তার এক সপ্তাহ আগে নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জে ঝড়ে আটটি বালুবোঝাই বাল্কহেড তলিয়ে যায়। তাতে দুজন বাল্কহেডের শ্রমিক নিখোঁজ হন।
মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন, নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য কোনো বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়নি। যেখানেই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, তা অবৈধভাবে। নদীতে চলাচলের জন্য কোনো নৌযান তৈরি করার আগে নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হয়। এরপর তার ফিটনেস পরীক্ষা করে অনুমোদন দেয় সংস্থাটি। পণ্যবাহী ওই নৌযানগুলোকে যাত্রী পারাপারের নৌপথ এড়িয়ে সতর্কভাবে চলাচলের শর্ত দেওয়া থাকে। কিন্ত ওই ৫০ কিলোমিটার নৌপথে যে বাল্কহেড চলাচল করছে, তার অধিকাংশেরই অনুমোদন নেই। অবৈধভাবে যাত্রী চলাচলের নৌপথ ব্যবহার করে যাত্রীবাহী নৌযানের সঙ্গেই তা চলছে।বিজ্ঞাপন
জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মাওয়া অঞ্চলের পরিদর্শক আমীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার পদ্মা নদীতে যে বাল্কহেড চলাচল করছে, তার অধিকাংশেরই কোনো অনুমোদন নেই। এ নৌযান তারা কোথায় নির্মাণ করে, তা–ও তাঁরা জানেন না। বালু ও পণ্য পরিবহনের জন্য এ অবৈধ নৌযান যেহেতু বেড়ে গেছে, তাই নদীতে অভিযান চালিয়ে তা জব্দ করা হবে। মালিক ও চালকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে অসংখ্য স্থানে বালু, পাথর ও বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী বিক্রি করা হয়। বাল্কহেডে করে ওই পণ্যগুলো আনা–নেওয়া করা হয়। আর নদী থেকেও অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে, যা ওই অবৈধ বাল্কহেডে পরিবহন করা হয়।
মাদারীপুরের কাঠালবাড়ি এলাকায় ২৫ ব্যবসায়ী বালু ও পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা পদ্মা সেতুর বিভিন্ন কাজে ও স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে ওই বালু ও নির্মাণসামগ্রী বিক্রি করেন, যা বাল্কহেডে পরিবহন করা হয়।
কাঠালবাড়ি এলাকার বালু ব্যবসায়ী জুলহাস ব্যাপারী বলেন, আগে পদ্মা নদী থেকে বালু তুলে বাল্কহেডে বোঝাই করে বিক্রি করতেন। এখন তা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন বাইরে থেকে বাল্কহেডে করে বালু এনে বিক্রি করছেন।
আজ মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত বাংলাবাজার ও কাঠালবাড়ি ঘাটে অবস্থান করে দেখা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের বাইরেও কয়েক শ বাল্কহেড চলাচল করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা নদীর শরীয়তপুরের জাজিরা অংশে বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করেন পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলতাফ হোসেন খান, নড়িয়া এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বাদশা শেখ, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করেন কোদালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খবির উদ্দিন খান ও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সুজন দেওয়ান। তাঁদের উত্তোলন করা বালু বাল্কহেড বোঝাই করে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।
জানতে চাইলে নড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বাদশা শেখ প্রথম আলোকে বলেন, নড়িয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি খননকাজ চলছে। খনন করা ওই বালু তিনি নিলামে কিনে নিয়েছেন। তা বাল্কহেড দিয়ে পরিবহন করছেন। বাল্কহেড ভাড়া নিয়েছেন, তা চলাচলের অনুমোদন আছে কি না, তা বলতে পারবেন না।
গতকাল স্পিডবোট দুর্ঘটনার পর মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক বলেছিলেন, নদীতে অবৈধ ও অনুমোদনহীন নৌযান চলাচল বন্ধ করবেন। আজ মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত বাংলাবাজার ও কাঠালবাড়ি ঘাটে অবস্থান করে দেখা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের বাইরেও কয়েক শ বাল্কহেড চলাচল করছে।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ এ নৌপথ দিয়ে চলাচল করে। তাদের চলাচল নিরাপদ করতে অবৈধ নৌযান নিয়ন্ত্রণ করা হবে। শিগগিরই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে অভিযান চালানো হবে।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান বলেন, পদ্মা নদী থেকে কেউ অবৈধভাবে বালু তুলতে করতে পারবেন না। অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে অবৈধ খননযন্ত্র ও বাল্কহেড জব্দ করা হয় এবং মালিকদের আইনের আওতায় আনা হয়।