ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী স্মরণে প্রকাশ পেয়েছিল একুশের পটভূমি: একুশের স্মৃতি (সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথম প্রকাশ: ২০০৩)। বাংলাদেশের মানুষ অমর একুশের ইতিহাস জানতে কতটা উৎসুক, তার প্রমাণ এ পর্যন্ত বইটির সাতটি মুদ্রণে (সপ্তম মুদ্রণ ২০২১, প্রথমা প্রকাশন)। ভূমিকায় বইয়ের সম্পাদক মতিউর রহমান অল্পকথায়, গভীর ব্যঞ্জনায় একুশকে অবলোকন করেছেন, যা এই বইয়ের বিশেষত্বের পরিচয়বহও বটে:
‘জনগণের কোনো সংগ্রামই আকাশ থেকে ঝরে পড়ে না, ইতিহাসের গভীরে তার শিকড়বাকড় ছড়ানো থাকে। এ ভূখণ্ডের অধিবাসীরাও হাজার বছর ধরে যে ধারাবাহিক লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে নিজেদের পায়ের তলায় দাঁড়ানোর মতো একটি শক্ত মাটি অনুসন্ধান করে যাচ্ছিল, আমরা মনে করি, একুশে তার এক উজ্জ্বল মুহূর্ত।’
বইয়ের ভূমিকায় উল্লিখিত জাতির জীবনের ‘উজ্জ্বল মুহূর্ত’ একুশের স্মৃতি ও পটভূমিকে ‘উপক্রমণিকা’, ‘পটভূমি’, ‘খণ্ডস্মৃতি’, ‘পূর্ণস্মৃতি’ ও ‘পরিশিষ্ট’—এই পাঁচ পরিচ্ছেদে ধারণ করা হয়েছে। এই বইয়ের একটি বিশিষ্টতার দিক হলো, এর ১২ জন লেখকের মধ্যে ৮ জনই বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী—আবদুল মতিন, গাজীউল হক, আহমদ রফিক, রফিকুল ইসলাম, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আনিসুজ্জামান, হাসান হাফিজুর রহমান ও রওশন আরা বাচ্চু। তাঁদের কলমে একুশের স্মৃতির বিস্তার ও পটভূমির পর্যালোচনা প্রামাণ্যতা পেয়েছে। আর বশীর আল হেলাল, হায়াৎ মামুদ, আতিউর রহমান, এম এম আকাশের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে একুশের জরুরি নানা দিক।বিজ্ঞাপন
বশীর আল হেলাল ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’-এর প্রণেতা। তিনি তাঁর ‘ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট’ প্রবন্ধে ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ, প্রজা আন্দোলন, লাহোর প্রস্তাব, স্বাধীন অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ও মুসলিম লীগবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের জন্ম-ইতিহাস বর্ণনা করে ভাষা আন্দোলনের ভিত্তিরূপটি পাঠকের কাছে স্পষ্ট করেছেন।
সদ্য প্রয়াত ভাষাসংগ্রামী আনিসুজ্জামানের ভাষা আন্দোলনের প্রাসঙ্গিক কথায় ১৯৪৭-৫২–এর সংগ্রামী পরিক্রমা উদ্ভাসিত হয় এভাবে:
‘১৯৪৭ সাল থেকেই সরকারবিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক সংগঠনের সূচনা হতে থাকে…একধরনের অসন্তোষ দেশের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের মার্চে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন পরিচালিত হয় প্রধানত ছাত্রদের নেতৃত্বে। জিন্নাহ ছাত্রদের নিরস্ত করতে পারেননি, কিন্তু আন্দোলন খানিকটা থিতিয়ে গিয়েছিল। ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমউদ্দীনের বক্তৃতা আবার চাবুক মেরে সেই আন্দোলনকে জাগিয়ে তুলেছিল।’
আতিউর রহমানের ‘অর্থনৈতিক বঞ্চনা ছিন্ন করার লড়াই’ শীর্ষক লেখায় এই মহান আন্দোলনের আর্থসামাজিক পটভূমি স্পষ্টতা পায়: ‘পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণী পূর্ববাংলার ওপর যে আঞ্চলিক নিপীড়ন চাপিয়ে দেয়, তারই প্রতিফলন ঘটে কখনো সংবিধানে, কখনো অর্থনীতি, কখনো ভাষাসংক্রান্ত নীতির মধ্য দিয়ে। যে ইস্যুকে কেন্দ্র করেই গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হোক না কেন, তার মূল অনুপ্রেরণা এসেছিল জাতিগত নিপীড়নের কারণে উদ্ভূত বিক্ষোভ থেকেই। ফলে ভাষা প্রশ্নে না হলেও পাকিস্তানি শাসকচক্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ ছিল অনিবার্য। আর পাকিস্তানের শাসকচক্রের ভাঁওতাবাজির প্রধান শিকার কৃষক-শ্রমিকই তৈরি করেছিল ভাষা আন্দোলনের নির্মাণ-রসদ।’
‘মধ্যবিত্তের গৌরবময় উত্থান’ রচনায় এম এম আকাশ একুশকে দেখেছেন বাঙালির নিজস্বতার রক্ষাকবচ হিসেবে, ‘ভাষা আন্দোলনের একটি অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে ইতিবাচক বিকল্প নির্মাণের শিক্ষা। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে বাঙালিরা নিজেরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরেই নানা ইতিবাচক ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
হায়াৎ মামুদের ‘সংস্কৃতি-দোলাচলে ভাষা আন্দোলন’ প্রবন্ধে একুশ থেকে একাত্তর—এই প্রবাহ ও পরিণতির সংগত ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে: ‘বাহান্নকে যে ধরা হয় একাত্তরের সূতিকাগার হিসেবে, তার কারণই এই যে চেতনা থেকে ভাষা আন্দোলন ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সেই সন্তানের ভবিতব্যই তাকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে টেনে নিয়ে গেছে।’
ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হকের স্মৃতিতে ভাস্বর ২৬ জানুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ কালপর্বের ‘ভাষার লড়াইয়ের তুঙ্গ মুহূর্তগুলো’। তাঁর বর্ণনায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার উত্তাল সময়টি যেন চাক্ষুষ করি আমরাও, ‘আবদুল মতিন শান্তভাবে যুক্তি দিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখলেন। সবশেষে সভাপতি হিসেবে আমি আমার বক্তব্য রাখি। আমার সেদিনের বক্তব্যের সব কথা মনে পড়ে না। তবে মোটামুটিভাবে শেষাংশ বোধ হয় এ রকম ছিল, “নুরুল আমিন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পুলিশ মোতায়েন করেছে। ১৪৪ ধারা ভাঙা হলে নাকি গুলি করা হবে—ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করা হবে। ১৪৪ ধারা আমরা ভাঙব। আমরা দেখতে চাই নুরুল আমিন সরকারের বারুদাগারে কত বুলেট জমা আছে।”’
ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমানের ‘বায়ান্নর ভাষার লড়াই’ শীর্ষক পুনর্মুদ্রিত রচনায় আছে সে সংকলন প্রসঙ্গ: ‘ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমি একটা সংকলন বের করি ১৯৫৩ সালের মার্চে। ২১ দিন পর মুসলিম লীগ সরকার সংকলনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।’
ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চুর লেখায় আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ এবং এক ভাষাসংগ্রামী নারীর করুণ পরিণাম উঠে এসেছে, ‘ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব নারীকে বড় রকমের মাশুল দিতে হয়, তাঁদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মমতাজ বেগম অন্যতম। তিনি শহীদদের রক্তশপথে নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে উজ্জীবিত করেছিলেন। এ কারণে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। বন্ড দিয়ে কারাগার থেকে তিনি মুক্তি লাভে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর স্বামী তাঁকে তালাক দেন। মমতাজ বেগমের সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।’
বইয়ের পরিশিষ্টে আছে, ‘ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ’। ১৯৪৭ থেকে চলমান ভাষা-বিতর্ক থেকে ১৯৯৯–এর ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা পর্যন্ত সুদীর্ঘ সংগ্রামী ও গৌরবদীপ্ত ঘটনাপ্রবাহ তারিখের ক্রমানুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
‘একুশে ফেব্রুয়ারির সুবর্ণজয়ন্তীতে’ নিবন্ধে ভাষাসংগ্রামী ও ভাষা-ভাবুক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আমাদের যে আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন করেন, তা ভাষা আন্দোলনের সাত দশক পূর্তির প্রাক্কালে আজকের একুশে ফেব্রুয়ারিতেও কি সমান প্রাসঙ্গিক নয়?:
‘ভাষার আন্দোলন, স্বাধীন রাষ্ট্রের আন্দোলন পেরিয়ে একটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান আমলে। ভাষা থেকে রাষ্ট্র হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রভাষাকে জনগণের মাঝে সাক্ষরতার মাধ্যমে রাষ্ট্র করার তেমন ঐকান্তিক চেষ্টা এখনো সার্থক হয়নি। আজ পঞ্চাশ বছর পরও আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার আওয়াজ তুলি। কারণ, সর্বস্তরে আজও রাষ্ট্রভাষা চালু হয়নি।’