দৈনিক নির্ভুল বার্তা ডেস্কঃ
বরিশাল সদর হাসপাতাল ডায়রিয়া রোগীতে ঠাসা। স্থান সংকুলান না হওয়ায় হাসপাতালের সামনে শামিয়ানা খাটিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি হাসপাতালের সামনে। ফাইল ছবি।
দেশের আনাচকানাচে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার খবর আসছে এক মাস ধরেই। সংবাদপত্রের মফস্বলের পাতা থেকে এ খবরগুলো দৃষ্টিগ্রাহ্য পাতার কোনায়, কোথাও কোথাও করোনার খবরের পাশেও জায়গা পেতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষার আগে এবং বর্ষা ও বন্যার পরে ডায়রিয়ার বতর লাগে। ঢাকার মহাখালীর কলেরা হাসপাতাল নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) শামিয়ানা টাঙিয়ে দিনরাত চিকিৎসা চলে। তবে এ বছর পরিস্থিতি একেবারেই অন্য রকম। বৃষ্টি নাই, তাপমাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এখন পর্যন্ত এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গত সপ্তাহে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১৩ ডিগ্রি বেশি। অন্যদিকে মার্চে গড়ে ২৫ মিলিমিটার ও এপ্রিলে কমপক্ষে ৯০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু মার্চ ছিল মোটামুটি বৃষ্টিশূন্য। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত (২৬ এপ্রিল) মাত্র ৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টির দেখা মিলেছে। দক্ষিণের জেলা বরগুনায় এপ্রিলে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাত ৯৩ মিলিমিটার। সেখানে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ২৪ মিলিমিটারের মতো।
বৃষ্টি কম হওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া লবণাক্ততা। বরিশাল বিভাগের ৪২টি নদ-নদীর প্রায় সবই এখন লবণাক্ততার ঝুঁকির মুখে। বরিশাল মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) জরিপ বলছে, কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, তেঁতুলিয়া, মাসকাটাল, কালাবদর, বলেশ্বর, পায়রা, বিষখালী, আন্ধারমানিক, লোহালিয়া, রামনাবাদ, আগুনমুখা প্রভৃতি নদ-নদীর পানিতেও লবণাক্ততার মাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। বছর দশেক আগেও এপ্রিল থেকে মে-জুন সময়ে এসব নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা অল্প হারে বাড়ত। এখনকার প্রবণতা হলো, এসব নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা ডিসেম্বর-জানুয়ারি থেকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। ভারী বৃষ্টি না হলে লবণাক্ততা কমে না।
মহামারির কেতাবি সংজ্ঞায় যা-ই বলা হোক না কেন, দক্ষিণাঞ্চল তথা বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়া যে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু করে এ বছর পর্যন্ত এত অল্প সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নজির এবারই প্রথম। এটা মহামারির সংজ্ঞায় পড়বে কি না, তা বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন।
পাঠকের মনে আছে, ২০১৯ সালে রাজধানীর ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে মহামারি বলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তখনকার মেয়র সাঈদ খোকন খেপে গিয়েছিলেন। তিনি সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের বলেছিলেন, ঢাকার পরিস্থিতিকে সংজ্ঞা অনুযায়ী মহামারি বলা যায় না। বলা বাহুল্য, তিনি সংজ্ঞার ভেদ ভাঙেননি। উপস্থিত সংবাদকর্মীরাও আর কথা বাড়াননি। সে যা-ই হোক, মহামারির যে একটা কেতাবি সংজ্ঞা আছে, তাতে কোনো ভুল নেই। সেই সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, টানা দুই সপ্তাহ ধরে প্রতি এক লাখ মানুষের ১৫ জনের চেয়ে বেশি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটতে থাকলে সেই পরিস্থিতিকে মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ের ভাষ্যমতে, বিভাগের ৪০টি উপজেলার মধ্যে ডায়রিয়া উপদ্রুত ১৮টি এলাকায় ৪০৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। আর হিসাব বলছে, উপকূলীয় জেলাগুলোতে দাস্ত বা পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সংক্রমণের প্রথম স্থানে রয়েছে উপকূলীয় জেলা ভোলা, দ্বিতীয় পটুয়াখালী ও তৃতীয় বরগুনা। যদিও মৃত্যু বেশি বরিশাল জেলায়। এ জেলায় ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ছয়জন মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাকি চারজনের মধ্যে দুজন পটুয়াখালী ও দুজন বরগুনার।
ডায়রিয়া পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে হোক অথবা বরিশালবাসীর উত্তম নেটওয়ার্কের কারণেই হোক, আইসিডিডিআরবির সাত সদস্যের একটি দল মার্চের শুরুর দিকে বরগুনায় যায়। বরগুনা সদরের বুড়িরচর, ঢলুয়া, গৌরীচন্না, ফুলঝুড়িসহ পৌরশহরের বেশ কিছু এলাকায় দলটি গবেষণা চালায়। গবেষকেরা এ সময় আক্রান্ত লোকজনকে পরীক্ষা করে তাঁদের শরীরে কলেরার জীবাণুও পান।
লাগামহীন মাত্রায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে থাকায় আইসিডিডিআরবি ছাড়াও জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকেও একটি গবেষক দল গিয়ে পরিস্থিতির হালহকিকত বোঝার চেষ্টা চালায়। দলটি ঢাকা থেকে গিয়ে যা জেনেছে, আর জানিয়েছে, তাতে নতুন কিছু নেই। ‘বোকার ফসল পোকায় খায়’ মার্কা একটা উপসংহার তারা উপহার দিয়েছে। দলটি বলেছে, এই অঞ্চলের মানুষ টিউবওয়েলের পানি পান করে। তবে অধিকাংশ মানুষ খাল, নদী বা ডোবার পানি রান্না ও থালাবাসন ধোয়ার কাজে ব্যবহার করেন। ফলে ডায়রিয়ার সংক্রমণ বেশি।
ভুলে গেলে চলবে না, ডায়রিয়া পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের দোলায় শুধু বরিশাল বিভাগ নয়, সারা দেশই দুলছে। জয়পুরহাটে হঠাৎ করে বেড়েছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিন (২৬ এপ্রিল পর্যন্ত হিসাব) জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে শয্যার অভাবে মেঝে ও বারান্দায় রেখে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফরিদা ইয়াছমিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শরণখোলায় ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ পানিসংকট। গত মঙ্গলবার এক দিনেই ২১ জন ডায়রিয়ার রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হন। শয্যাসংকটের কারণে রোগীদের কাউকে কাউকে মেঝেতে রাখতে হচ্ছে। এ নিয়ে গত ১ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ১৪০ জন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন। তবে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বেশি।
পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ির সদর হাসপাতালে প্রতিদিনই রোগীর চাপ বাড়ছে। সেখানে গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে ডায়রিয়ার সঙ্গে নিউমোনিয়া নিয়েও শিশুরা হাসপাতালে আসছে। শিশু ওয়ার্ডে কোনো শয্যা খালি নেই। খুলনা শিশু হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে গত মাস এপ্রিলের শুরু থেকেই।
উত্তরের জনপদ দিনাজপুরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগীর জন্য শয্যা আছে ১০টি। কিন্তু গত ২৬ এপ্রিল সকালে ভর্তি ছিলেন ৪৮ জন। জেলা সিভিল সার্জন সংবাদমাধ্যমকে জানান, শুধু জেনারেল হাসপাতালই নয়, ওই দিন জেলার মোট ১২টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেড় শতাধিক ডায়রিয়া রোগী ভর্তি ছিলেন। এ ছাড়া ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত বহির্বিভাগে ডায়রিয়াজনিত সমস্যায় চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন ছয় শতাধিক রোগী।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ২৬ এপ্রিল সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে ২৯ জন রোগী ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও পেটব্যথা নিয়ে ভর্তি হন। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরেও পরিস্থিতি ভালো নয়। সেখানকার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও এলাকা থেকে রোগী আসা বাড়ছিল। অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়।
সব মিলিয়ে ডায়রিয়ার প্রকোপের এই তালিকা বড় দীর্ঘ। তবে সব জায়গায় যে গুরুত্বের সঙ্গে সাড়া দিতে হবে, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো করোনার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ডায়রিয়াকে।
ভিন্ন উপসর্গের কথা শোনা যাচ্ছে
এবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত মানুষের অনেকেরই বমি ও পায়খানা একসঙ্গে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগে বমি পরে পায়খানা দিয়ে অসুস্থতা শুরু হচ্ছে। খুব দ্রুত শকে (সাড়া না দেওয়া) চলে যাচ্ছেন রোগী। সাম্প্রতিককালে করোনার উপসর্গ হিসেবে পাতলা পায়খানার কথা শোনা যাওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে ‘ইলেকট্রোলেট ইমব্যালান্সের’ (দেহের খনিজ অসমতা) আভাস মিলেছে এবং সেইমতো চিকিৎসা দিয়ে সুফল পাওয়া গেছে। রোগী মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। তবে যেসব রোগীর শ্বাসকষ্ট বা অন্যান্য জটিলতা আছে, তাঁরা ভুগছেন বেশি। কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন।
আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবিকে কথিত নতুন উপসর্গ ও তার ব্যাপ্তি নিয়ে ভাবতে হবে। দেখতে হবে করোনার উপসর্গের সঙ্গে নতুন ডায়রিয়ার আসলেই কোনো তাললুকাত আছে কি নেই। প্রতিটি সংকট নতুন সম্ভাবনার, নতুন গবেষণার সুযোগ দেয়। আমরা সেই সুযোগগুলো কি শুধু হাতছাড়াই করে যাব?
সুযোগে স্যালাইন সংকট
রোগীর বাড়তি চাপ আর রোগের লাগামহীন বিস্তারের আলামত থাকলেই চিকিৎসা সামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। যেসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য শয্যা মাত্র ১০টি, সেসব জায়গায় ভর্তি অনেক বেশি রোগী। পটুয়াখালীর বাউফলে ছিলেন ৮০ জন। সম্প্রতি সেখানে ৩ জনের মৃত্যুর খবর রটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলেরা স্যালাইনের জন্য হাহাকার পড়ে যায়। কোনো কোনো এলাকায় ৭০ টাকার স্যালাইন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। দেশের প্রায় সব সিভিল সার্জন একবাক্যে জানিয়েছেন, তাঁদের হাতে যথেষ্ট স্যালাইন মজুত আছে। খাতা আর গোয়ালের হিসাব এ যাত্রায় মিললে ভালো।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটা স্বাভাবিক কৌশল হচ্ছে, মজুত ধরে রাখা। তাই ভান্ডারে ওষুধ থাকলেও রোগীর সহচরদের বলেন ‘কিনে আনেন’। যখন একই ওষুধ ১০ জন কিনতে যান, তখন দোকানিরা দাম বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যান। দাম বাড়ে, মজুত বাড়ে, বাজারে আলো নিভে কালো হয়ে যায়। বাড়ির মুরুব্বিদের মধ্যে আমরা সংকটের সময় সমঝিয়ে খরচ করার যে সংস্কৃতি দেখেছি, সেটাই আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রে অনুসরণ করি। এটাও দাম বাড়ার একটা কারণ হতে পারে।
স্যালাইন দিয়ে কি ডায়রিয়া থামানো যাবে
স্যালাইন দিয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু ডায়রিয়ার বিস্তার রোধ করে তাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হলে নিরাপদ পানি সহজলভ্য করতে হবে, সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে হবে। আমাদের দেশে বৃষ্টি এই কাজটা নিজের খুশিতে করে থাকে। যে বছর তারা দেরিতে আসে, সে বছর আমরা কাহিল হয়ে যাই। অথচ এক বর্ষার পানি ঠিকমতো ধরে রাখতে পারলে তিন বছর ব্যবহার করা যায়। এত অল্প জায়গায় মিঠাপানির এত ভারী বৃষ্টি পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। প্রতিবেশীরা নদী আটকাবেই, আমাদের লবণাক্ততা তাতে আরও বাড়বে। কিন্তু বৃষ্টির পানি একটা দিশা দিতে পারে।
আমাদের নিরাপদ পানির বিকল্প ব্যবস্থা করতেই হবে। না হলে কিছুই টিকবে না। শাহবাগ, দোয়েল, শাপলা, কদম, শহীদ মিনার, চারুকলা, বুলবুল, ছায়ানট, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ—সবই থাকবে বিপদে।
লেখক ও গবেষক