ঢাকাTuesday , 4 May 2021
  1. blog
  2. Catalog of articles
  3. dating
  4. dating-advice
  5. Discussione
  6. erotic lingerie
  7. Forum dei Sahaj Yogi dell'Ucraina
  8. Mail Order Brides
  9. Online dating
  10. Varie
  11. washine machine
  12. Болталка
  13. ВордПресс
  14. Головна
  15. Курилка
আজকের সর্বশেষ সবখবর

মুজিব বন্দী হলেন যে রাতে

rabbi
May 4, 2021 7:21 am
Link Copied!

দৈনিক নির্ভুল বার্তা ডেস্কঃ

মেজর জেড এ খান (পরে ব্রিগেডিয়ার) ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে যোগ দেন। এই ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল কুমিল্লায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের অভিযান পরিচালনা করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের এ অংশটুকু নেওয়া হয়েছে জেড এ খানের দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ (ডাইনাভিস প্রাইভেট লিমিটেড, করাচি, ১৯৯৮) থেকে।

মার্চ মাসের ২৩ তারিখ দুপুরে আমাকে জানানো হলো, গ্যারিসনের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিয়ে একটা সি-১৩০ [পরিবহন বিমান] কুমিল্লা বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। ঢাকায় এক রাত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ইত্যাদি নিয়ে ইউনিফর্ম পাল্টে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আমার স্ত্রী বলল, আমি যেন আমার অফিসের সেফে রাখা ওর গয়নাগুলো ওকে দিয়ে যাই। সেদিন সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবের পার্টিতে ওগুলো পরে যাবে ও। আমাদের ঘরে গয়না রাখার মতো কোনো নিরাপদ জায়গা ছিল না। কুমিল্লার ব্যাংকগুলোতেও লকার ছিল না কোনো। আমি গয়নাগুলো ওকে এনে দিই। পরের ঘটনাবলি যেভাবে ঘটেছিল, ভাগ্যিস, এনে দিয়েছিলাম ওগুলো!

এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার পথে একটা ন্যাংটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার জিপটা দেখে ছেলেটা হিংস্রভাবে চিৎকার করে ওঠে, ‘জয় বাংলা’। আমার আড়াই বছরের মেয়েটাকেও দেখতাম ‘জয় বাংলা’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির চারপাশে দৌড়াদৌড়ি করতে, যদিও ওর বড় বোন চাইত ওকে বাধা দিতে।

‘সাধারণ ধর্মঘট’ শুরু হওয়ার পর আমার ব্যাটালিয়নের হামজা কোম্পানির একটা প্লাটুন নিয়ে কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সি-১৩০ বিমানটি কুমিল্লা গ্যারিসনের জন্য রেশন নিয়ে এসেছিল। টিনের দুধ, চিনি ইত্যাদি নামানোর কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওটা টেক অফ করে। বিমানটার পাইলট ছিল স্কোয়াড্রন লিডার আবদুল মুনিম খান। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে করতে ঢাকায় পৌঁছে যাই।

সেদিন ২৩ মার্চ, পাকিস্তান দিবস বলে সব ভবনশীর্ষে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ার কথা। আমরা যখন ঢাকার ওপর দিয়ে উড়ছিলাম, দেখি, সারা শহরে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। আমি ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসে পৌঁছার পর কেউ একজন আমাকে জানায়, কেবল একটা পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বিহারি কলোনিতে। আরও কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে আমি একমাত্র পাকিস্তানি পতাকাটা দেখার জন্য ওখানে গিয়েছিলাম।

মেজর বিলালকে [কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অফিসার] জানানো হয়েছিল যে সি-১৩০ বিমানটিতে করে আমি যাব। তাই ও এয়ারপোর্টে গিয়ে আমাকে রিসিভ করে। এয়ারপোর্ট থেকে অফিসার্স মেসে যাওয়ার পথে ও আমাকে বলে, ওর প্রতি নির্দেশ আছে, যাতে আমাকে মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারের কর্নেল এস ডি আহমদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বলে আমরা অফিসার্স মেসে কর্নেলের রুমে চলে যাই। তিনি আমাকে বললেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পরদিন অথবা তার পরদিন গ্রেপ্তার করতে হবে; আমি যেন প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা তৈরি করি। তিনি আমাকে আরও বললেন, ইউনাইটেড ব্যাংকের জোনাল ম্যানেজার দুটো গাড়ি আমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন, যাতে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান, জরিপ ইত্যাদি কাজ সেরে নিতে পারি আমি।

সে সন্ধ্যায় মেজর বিলাল, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন [কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অফিসার] ও আমি ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির চারপাশ ঘুরে আসি। মোহাম্মদপুর থেকে আসা রাস্তা থেকে একটা গলি বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে গেছে; গলিটার অন্য পাশে ছিল একটা লেক। বাড়িটার কাছে বেশ বড়সড় একটা জটলা দেখি, পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের প্রহরীও ছিল ওখানে। আমরা সামনে দিয়ে যখন গাড়ি চালিয়ে যাই, তখন একদল হিন্দু বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল। কেউ আমাকে চ্যালেঞ্জ করেনি। কারণ, আমরা ধানমন্ডিতে ঢুকে আবার বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।

পরদিন সকালে আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার রাস্তাগুলো পরীক্ষা করি। রাস্তা ছিল দুটো। প্রধান সড়কটা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ‘ফার্মগেট’ নামের এক জংশন পর্যন্ত। সেখান থেকে একটা রাস্তা ধানমন্ডি পর্যন্ত চলে গেছে। দ্বিতীয়টা এমএনএ হোস্টেল থেকে জাতীয় পরিষদ ভবন পর্যন্ত গিয়ে মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি রোডকে যুক্ত করেছে। ঢাকা বিমানবন্দরে ঢোকা এবং বের হওয়ার সব কটি রাস্তা ছিল ক্যান্টনমেন্টের দিকে। তবে অন্য পাশে একটা গেট ছিল, যেটা দিয়ে এমএনএ হোস্টেল এবং জাতীয় পরিষদ রোডের ওদিকে বের হওয়া যেত। গেটটা তৈরি করা হয়েছিল বিমান পর্যবেক্ষক ইউনিট, যাতে এয়ারফিল্ডে আসা-যাওয়া করতে পারে।বিজ্ঞাপন

শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার আনুষ্ঠানিক আদেশের জন্য আমাকে ২৪ মার্চ বেলা ১১টায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর [পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা] কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি জেনারেলের অফিসে গেলে তিনি আমাকে বলেন, পরের রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তাঁর নির্দেশ শুনে স্যালুট করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে থামালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাজটা কীভাবে করতে হবে, সেটা শুনতে চাও না?’ আমি তাঁকে বলি, কীভাবে কোনো নির্দেশ পালন করতে হবে, সেটা বলে দেওয়ার রেওয়াজ নেই, তবে তাঁর মনে যেহেতু কিছু একটা আছে, তিনি তা বলতে পারেন। তখন তিনি বলেন, আমি একটা বেসামরিক গাড়িতে একজনমাত্র অফিসার নিয়ে যেতে পারব এবং সেভাবেই শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করতে হবে। আমি বলি, বাড়ির চারপাশে যে পরিমাণ ভিড় থাকে, তাতে এক কোম্পানির কমে কাজটা করা সম্ভব হবে না। তিনি তখন বললেন, এটা তাঁর নির্দেশ এবং তিনি যেভাবে বলেছেন, নির্দেশটা সেভাবেই পালন করতে হবে। আমি তখন তাঁকে বলি, তাঁর আদেশ আমি গ্রহণ করছি না এবং কাজটা করার জন্য তিনি যেন অন্য কাউকে দায়িত্ব দেন। তারপর তিনি কিছু বলার আগে স্যালুট করে তাঁর অফিস থেকে বেরিয়ে আসি আমি।

বুঝতে পারি, বিপদে পড়েছি। দিনের বাকি সময়টা আমি এমন জায়গায় কাটালাম, যেখানে আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে না পারে। এ সময় খবর পেলাম, মেজর জেনারেল এ ও মিঠ্ঠা [পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল] পিআইয়ের এক ফ্লাইটে ঢাকা আসছেন; বিকেল পাঁচটায় তাঁর পৌঁছার কথা। ফ্লাইট যখন পৌঁছায়, আমি তখন এয়ারফিল্ডে অপেক্ষমাণ। তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমার ওপর নির্দেশের কথা তাঁকে বলি এবং এটাও জানাই যে বাড়িটার সামনে সমবেত জনতার কারণে কেবল একটা গাড়ি চালিয়ে গিয়ে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব নয়। জেনারেল নয়টার সময় আমাকে ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

পরদিন সকাল নয়টা বাজার আগেই আমি ইস্টার্ন কমান্ডে কর্নেল আকবরের (পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার) অফিসে যাই। ঢুকেই দেখি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী সেখানে বসা। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে কেন গিয়েছি আমি? আমি জানাই, মেজর জেনারেল মিঠ্ঠার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। তিনি তখন কর্নেল আকবরকে নির্দেশ দেন, যাতে একটা হেলিকপ্টার জোগাড় করে ১৫ মিনিটের মধ্যে আমাকে ঢাকা থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কর্নেল আকবর একবার আমার দিকে, আরেকবার জেনারেলের দিকে তাকান। তারপর আর্মি এভিয়েশন বেসে টেলিফোন করেন। ফোনে আলাপ শেষ করে বলেন, হেলিকপ্টার তৈরি হতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। আমি কর্নেল আকবরকে জিজ্ঞেস করি, মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা এসেছেন কি না, কিংবা আসার কথা আছে কি না। তিনি জানালেন যে তিনি (জেনারেল) লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কার রুমে আছেন। আমি তখন শরীরটা এমনভাবে ঘুরিয়ে বসলাম, যাতে জেনারেল টিক্কার অফিসে ঢোকার দরজাটা দেখা যায়। অস্বস্তিকর ১৫টা মিনিট কাটার পর দরজাটা খোলে এবং জেনারেল মিঠ্ঠা বেরিয়ে আসেন। আমি এক লাফে কর্নেল আকবরের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে জেনারেলকে [জেনারেল মিঠ্ঠা] ধরি এবং কী ঘটেছে, তাঁকে জানাই। জেনারেলের স্টাফ কার দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে, তিনি আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন। আমরা জেনারেল আবদুল হামিদ খান [পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান] যেখানে থাকতেন, সেখানে রওনা হই।

জেনারেল হামিদের বাসার এক ওয়েটিংরুমে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর আমাকে ভেতরে ডেকে নেওয়া হয়। মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা আমাকে বলেন, আমি তাঁকে যা বলেছি, সেসব যাতে জেনারেল হামিদকে খুলে বলি। জেনারেল হামিদ আমার কথা শোনেন, তারপর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে টেলিফোন করে বলেন যে আমাকে তাঁর কাছে পাঠাচ্ছেন তিনি এবং আমার যা যা প্রয়োজন, সব যাতে মেটানো হয়। আর আমাকে তিনি বলেন, আমাকেই শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তাঁকে জীবিত অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। আমি যখন বেরোনোর জন্য দরজার কাছে পৌঁছাই, তিনি আমার নাম ধরে ডাক দেন। আমি ফিরে তাকালে বলেন, ‘মনে রেখো, তাঁকে জ্যান্ত অবস্থায় ধরতে হবে, যদি সে মারা যায়, তবে আমি তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করব।’

আমি তখন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর অফিসে যাই। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমার কী কী জিনিস লাগবে। আমি বলি, সৈন্য বহনকারী তিনটা গাড়ি এবং বাড়িটার একটা নকশা দরকার আমার। তাঁর কাছে বাড়িটার নকশা ছিল। সেটা আমাকে দিলেন এবং বললেন, গাড়ির ব্যবস্থাও হবে। আমি তাঁকে বলি, শেখ মুজিবের বাড়ির পেছনে জাপানি কনসালের বাড়ি। সে যদি কূটনীতিকের বাড়িতে ঢুকে পড়ে, তাহলে আমি কী করব। জেনারেল সে ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি খাটাতে বললেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি এবং সেখানে যাওয়ার রাস্তার একটা মডেল তৈরি করা হলো; ইস্যু করা হলো গোলাবারুদ। রাতের খাবার খাওয়ার পর আমি আমার কোম্পানিকে ব্রিফ করলাম। কোম্পানিকে আমি তিনটা দলে ভাগ করি। ক্যাপ্টেন সাইদের [কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অফিসার] নেতৃত্বে ২৫ জনের একটা দল শেখ মুজিবের বাড়ির চারদিকে প্রতিবন্ধকতার সাহাঘ্যে ঘেরাও দেবে। প্রথমে মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়ক থেকে যে গলিটা বাড়ির দিকে ঢুকেছে, সেদিকটা বন্ধ করে দেবে। দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকটি হবে প্রথম ডান দিকের মোড়ে। তৃতীয়টা হবে দ্বিতীয় ডান দিকের মোড়ে, আরেকটা হবে মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়কের পেছনে, যাতে জাপানি কূটনীতিকের বাড়িসহ পেছনের সব কটি বাড়িকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের নেতৃত্বে ২৫ জনের দ্বিতীয় দলটা প্রথম দলকে অনুসরণ করে শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে পৌঁছাবে। তারপর পাশের বাড়ির সীমানার ভেতর থেকে দেয়াল টপকে শেখের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে বাড়ির চারপাশ ঘিরে একটা বৃত্ত তৈরি করে ফেলবে। এই দল বিশেষভাবে লক্ষ রাখবে যাতে কেউ জাপানি কূটনীতিকের বাড়িতে ঢুকে পড়তে না পারে। ১২ জনের তৃতীয় দলটার নেতৃত্বে থাকবে মেজর বিলাল। এ দলের কাছে বৈদ্যুতিক টর্চলাইট ইত্যাদি থাকবে। বাড়িটা তল্লাশি করবে এরা। প্রথমে নিচতলা, তারপর ওপরের তলা। আমাদের মিলিত হওয়ার স্থান ঠিক হলো এমএনএ হোস্টেলের দিকে এয়ারফিল্ডের গেটে। আর রাস্তা হবে এয়ারফিল্ড, জাতীয় পরিষদ ভবন, মোহাম্মদপুর হয়ে ধানমন্ডি। আমার জিপ পুরো হেডলাইট জ্বালিয়ে সামনে থাকবে। ক্যাপ্টেন সাইদ, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন আর মেজর বিলাল বাতি না জ্বালিয়ে তাদের ট্রাক নিয়ে আমাকে অনুসরণ করবেন—এটার উদ্দেশ্য ছিল হেডলাইটের দিকে তাকিয়ে যাতে কেউ আন্দাজ করতে না পারে পেছনে কয়টা গাড়ি আছে। আমাকে বলা হয়েছিল, অপারেশনটা শুরু করতে হবে মাঝরাতে। আরেকটা পাসওয়ার্ড (সাংকেতিক শব্দ) দেওয়া হয়েছিল, যেটা পুরো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য।

অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে বিস্তারিত পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলা হলো। তারপর পুরো কোম্পানি এয়ারফিল্ডে গিয়ে বের হওয়ার গেটের কাছে জড়ো হয়। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে বেসামরিক পোশাকে ওর দলের দুজনসহ বেসামরিক গাড়িতে পাঠানো হলো একটা চক্কর দিয়ে শেখের বাড়ির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসতে।

অন্ধকার হয়ে এলে সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বের হয়ে সঙ্গে যা যা নিয়ে থাকে, সেসব নিয়ে গাড়ি ভর্তি করা হয়। তারপর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে রওনা হয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরিচিত যে কেউই স্পষ্ট বুঝতে পারত কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। পরে এটা জানা যায় যে বাঙালি অফিসাররা শেখ মুজিবকে জানিয়ে দিয়েছিল, সেনাবাহিনী সে রাতে কিছু একটা করতে যাচ্ছে।

রাত প্রায় নয়টার দিকে আমি এয়ারফিল্ডের দিকে যাই। আমার জিপ বিমানবন্দর এলাকায় ঢুকলে এক সৈনিক আমাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং পাসওয়ার্ড জানতে চায়। আমি পাসওয়ার্ড জানাই। সে জানায় যে ওটা পাসওয়ার্ড নয়। তার সঙ্গে তর্ক শুরু হয়ে যায়। আমি বলি যে আমি কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক। সে জানায় যে পাসওয়ার্ড ছাড়া আমার এয়ারফিল্ডে ঢোকা যাবে না। সে কোন ইউনিটের সৈনিক জিজ্ঞেস করলে জানায়, বিমানবিধ্বংসী ইউনিটের সদস্য। আমি তখন আমাকে ওর কমান্ডিং অফিসারের কাছে নিয়ে যেতে বলি। এয়ারফিল্ড পেরিয়ে অ্যান্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারের দিকে যাওয়ার সময় সৈনিকটি আমার দিকে রাইফেল তাক করে ধরে রেখেছিল। রেজিমেন্ট কমান্ডার আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তবে পুরো ব্যাপারটাতে খুব মজা পান। তিনি জানান, আমাকে যে পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে, তাঁকে সেটা দেওয়া হয়নি, আর যেহেতু তাঁর ইউনিট এয়ারফিল্ড পাহারায় নিয়োজিত, তিনি নিজেই নিজেদের পাসওয়ার্ড বানিয়ে নিয়েছেন।

রাত প্রায় ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন হুমায়ুন শেখ মুজিবের বাড়ির চারপাশ রেকি করে এসে রিপোর্ট করে, মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়কে প্রতিবন্ধক তৈরির কাজ চলছে। কোম্পানির সব কটি রকেট লাঞ্চার নিয়ে আসতে নির্দেশ দিই আমি; প্রতিটির সঙ্গে দুই রাউন্ড গোলা। রকেট লাঞ্চারধারী সৈনিকদের ক্যাপ্টেন সাইদের দলের সঙ্গে থাকতে বলা হলো। এ দলকে নির্দেশ দেওয়া হলো রোড ব্লকের মুখোমুখি হলে সৈনিকেরা এক লাইনে এগোবে, মাঝে থাকবে রকেট লাঞ্চারধারী। প্রথমে রকেট ছোড়া হবে, তারপর সব কটি রাইফেল একসঙ্গে। আমি ব্যাখ্যা করে বলি যে ব্যারিকেডের আশপাশের জনতা আগে কখনোই রকেট লাঞ্চার থেকে গোলা ছোড়া এবং বিস্ফোরণের দ্বৈত আওয়াজ শোনেনি। তাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। অন্য একটা দলকে রাস্তার দুই পাশে লক্ষ রাখতে বলি আমি। রাস্তায় প্রতিবন্ধকগুলো মজবুত করে তৈরি করার সময় কমিয়ে আনার জন্য নিজ উদ্যোগে অপারেশন শুরুর সময় মধ্যরাত থেকে এগিয়ে রাত ১১টা নির্ধারণ করেছিলাম।

২৫-২৬ মার্চের রাত ১১টায় আমরা এয়ারফিল্ড থেকে বের হয়ে এমএনএ হোস্টেল থেকে মোহাম্মদপুর অভিমুখী রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই। রাস্তার বাতি ছিল নেভানো, সমস্ত বিল্ডিং অন্ধকার, আমার জিপের হেডলাইট পুরো জ্বালানো, সিগন্যাল কোরের কাছ থেকে নেওয়া সেনাবাহী গাড়িগুলো বাতি নিভিয়ে আমার জিপের পেছন পেছন আসছিল। ঘণ্টায় প্রায় ২০ মাইল বেগে কনভয়টা মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়কের ওপর বাঁয়ে মোড় নেয়। ধানমন্ডি থেকে প্রায় সিকি মাইল আগে রাস্তার ওপর ট্রাক ও অন্যান্য গাড়ি কাত করে ফেলে রেখে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ মোতাবেক ক্যাপ্টেন সাইদের দল লাইন করে দাঁড়ায়। প্রথমে রকেট নিক্ষেপ করে, তারপর রাইফেল থেকে গুলি করা শুরু করে; রাস্তার পাশের দলগুলোও গুলি করতে থাকে। প্রায় দু-তিন মিনিট পর আমি গুলি বন্ধ করার আদেশ দিলাম। কিন্তু দেখলাম যে আদেশ মানা হচ্ছে না। তাই আমাকে জনে জনে গিয়ে গুলিবর্ষণ বন্ধ করাতে হয়। ব্যারিকেড তৈরিতে ব্যবহৃত গাড়িগুলোতে আগুন ধরে যায়। দেখলাম যে একটা সাদা ভক্সওয়াগন কম্বি দাউ দাউ করে জ্বলছে, ব্যারিকেড অক্ষতই থেকে গেল। তবে ওটা রক্ষা করার জন্য যারা ছিল, তারা সব ততক্ষণে উধাও। রোডব্লকের মাঝখান দিয়ে কীভাবে একটা ফাঁক সৃষ্টি করা যায়, আমি সেটা ভাবছিলাম। সেনা বহনকারী গাড়িগুলো আগে পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু ওগুলোর দিকে তাকাতেই লক্ষ করলাম যে উইঞ্চ (কপিকল/ক্রেন) ফিট করা একটা পাঁচ টনি ট্রাক আছে। দুটি গাড়ির সাহায্যে আমরা রোডব্লকের কিছু গাড়ি টেনে সরিয়ে ফাঁক তৈরি করতে সমর্থ হলাম। তারপর আবার গাড়িতে আরোহণ করলাম এবং রওনা হলাম।

প্রায় ২০০ গজ এগোনোর পর আরেকটা রোডব্লকের সম্মুখীন হলাম আমরা। এবার প্রায় দুই ফুট ব্যাসের পাইপ, ওগুলোর দৈর্ঘ্য দুপাশের উঁচু দেয়ালের মধ্যবর্তী রাস্তার পুরোটাই বন্ধ করে রেখেছে। আমরা উইঞ্চের মোটা ধাতব রশি পাইপের মাঝবরাবর বেঁধে টান লাগাই। এতে করে পুরো প্রতিবন্ধকটা গড়িয়ে গাড়ির দিকে সরে আসে, কিন্তু রাস্তাজুড়ে থাকে একইভাবে। তখন উইঞ্চ কেবল বাঁধা হলো পাইপের এক মাথায় আর ক্যাপ্টেন সাইদের লোকজনকে অন্য মাথায় বসিয়ে টান দেওয়া হলো। এতে পাইপ কেন্দ্র থেকে ঘুরে যায়, গাড়ি পার হওয়ার মতো ফাঁক সৃষ্টি হয় এতে। আমরা আবার আমাদের বাহনে উঠে রওনা হই।

আমরা আরও শ দুয়েক গজ গেলে আরেকটা প্রতিবন্ধক পথে পড়ে। এটি প্রায় তিন ফুট উঁচু আর চার ফুট প্রশস্ত করে জড়ো করা ইট দিয়ে তৈরি। আমরা ট্রুপস ক্যারিয়ার দিয়ে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির জন্য রাস্তা তৈরি করে নিতে চাইলাম। কিন্তু সম্ভব হলো না। তখন ক্যাপ্টেন সাইদের দলকে নির্দেশ দিলাম যাতে হাতে হাতে ইট সরিয়ে গাড়ি বের হয়ে যাওয়ার মতো প্রশস্ত পথ তৈরি করে নেয়। বাহিনীর বাকি সদস্যদের বললাম গাড়ি ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা হওয়ার জন্য।

আমরা মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়ক ধরে হেঁটে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে অগ্রসর হই। তারপর লেক এবং সে বাড়ির মধ্যবর্তী গলিতে ঢোকার জন্য ডানে মোড় নিই। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের বাহিনী শেখ মুজিবের বাড়ির পাশের বাড়ির ভেতর দিয়ে ছুটে গিয়ে দেয়াল টপকে শেখ মুজিবের বাড়িতে প্রবেশ করে। গুলি বর্ষণ করা হয়, কম্পাউন্ডের ভেতর থেকে কিছু লোক গেট পেরিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়, একজন মারা যায়। বাড়ির বাইরে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের প্রহরী দল তাদের ১৮০ পাউন্ডের তাঁবুতে ঢুকে খুঁটিসমেত তাঁবু উঠিয়ে নিয়ে লেকের দিকে পালিয়ে যায়। শেখ মুজিবের সীমানাদেয়াল নিরাপদ করা হলো, আলকাতরার মতো অন্ধকার চারপাশে, মুজিবের বাড়ি ও আশপাশের বাড়িতে কোনো বাতি নেই।

তখন সার্চ পার্টি বাড়িটাতে ঢোকে। শেখ মুজিবের এক প্রহরীকে নিয়ে একজন সৈনিক পাশে পাশে হেঁটে আসছিল। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে যাওয়ার পর সেই প্রহরী একটা দা, লম্বা ফলাওয়ালা ছুরি বের করে সৈনিকটিকে আক্রমণ করে। সে জানত না পেছন থেকে ওকে কাভার দেওয়া হচ্ছে। ওকে গুলি করা হয়, তবে মেরে ফেলা হয়নি। নিচতলা সার্চ করা হয় কিন্তু কাউকে পাওয়া যায় না। অনুসন্ধানী দল ওপরতলায় যায়। যেসব কামরা খোলা ছিল, ওখানে কাউকে পাওয়া গেল না। একটা কামরা ভেতর থেকে আটকানো। আমি ওপরতলায় গেলে একজন আমাকে বলে, বন্ধ কামরাটার ভেতর থেকে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমি মেজর বিলালকে বন্ধ কামরাটার দরজা ভেঙে ফেলতে বলে ক্যাপ্টেন সাইদ এসেছে কি না এবং অন্য কোনো লোকজন জড়ো হয়েছে কি না, দেখার জন্য নিচতলায় নেমে আসি।

বাইরে বেরিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় নেমে দেখি বাহনগুলো নিয়ে ক্যাপ্টেন সাইদও এসে পৌঁছে গেছে। তবে পাঁচ টনি গাড়িগুলো ঘোরানোর সময় বাড়ির সামনের সরু রাস্তা আটকে ফেলেছে। আমার জিপের ওয়্যারলেসের লাউড স্পিকারে শুনতে পাই ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, [ঢাকাস্থ ৫৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক] তাঁর ইউনিটগুলোর একটিকে তাঁদের ‘রোমিও রোমিওগুলো’ [রিকয়েললেস রাইফেল] ব্যবহার করার জন্য তাড়া দিচ্ছেন।

আমি যখন ক্যাপ্টেন সাইদকে গাড়িগুলো কীভাবে লাইন করতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছিলাম, তখন প্রথমে একটা গুলির শব্দ, তারপর গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং শেষে সাবমেশিনগান থেকে ব্রাশফায়ারের আওয়াজ শুনতে পাই। ভাবলাম কেউ বুঝি শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। আমি ছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকে ওপরতলায় গিয়ে যে ঘরটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সেটার দরজার সামনে কম্পিত অবস্থায় শেখ মুজিবকে দেখতে পাই। আমি তাঁকে আমার সঙ্গে যেতে বলি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারবেন কি না। আমি অনুমতি দিই। তিনি কামরাটার ভেতর গেলেন। সেখানে তাঁর পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে আসেন। আমরা গাড়িগুলো যেখানে, সেদিকে হাঁটতে থাকি। ক্যাপ্টেন সাইদ তখনো ওর গাড়িগুলো ঘোরাতে সক্ষম হয়নি। আমি ইস্টার্ন কমান্ডে একটা রেডিও বার্তা পাঠাই যে শেখ মুজিবকে ধরা গেছে।

শেখ মুজিব এ সময় আমাকে বলেন, তিনি ভুলে পাইপ ফেলে এসেছেন। আমি আবার তাঁর সঙ্গে ফিরে আসি। তিনি পাইপ নিয়ে আসেন। এর মধ্যে শেখ মুজিব নিশ্চিত হয়ে গেছেন, আমরা তাঁকে হত্যা করব না। তিনি বলেন, আমরা তাঁকে ডাকলেই হতো, তিনি নিজ থেকেই বেরিয়ে আসতেন। আমি তাঁকে বলি, আমরা তাঁকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়। আমরা ফিরে আসতে আসতে ক্যাপ্টেন সাইদ ওর গাড়িগুলো লাইন করে ফেলে। শেখ মুজিবকে মাঝের সৈন্য বহনকারী গাড়িতে ওঠানো হয়। আমরা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাত্রা করি। পরে জানতে পারি যে আমি মেজর বিলালকে ওপরতলার বন্ধ রুমের দরজাটা ভাঙার জন্য বলে গাড়ির অবস্থা দেখার জন্য যখন নিচে নেমে আসি, তখন কেউ একজন ওর সৈন্যরা যেখানে জড়ো হয়েছিল, সেদিক লক্ষ করে পিস্তল দিয়ে এক রাউন্ড গুলি করে। ভাগ্যক্রমে কেউ আঘাত পায়নি। কেউ থামানোর আগেই ওর এক সৈনিক বারান্দার যেদিক থেকে পিস্তলের গুলি এসেছিল, সেদিকে একটা গ্রেনেড ছুড়ে মারে। তারপর সাবমেশিনগান থেকে একপশলা গুলি। গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং সাবমেশিনগানের শব্দে শেখ মুজিব বন্ধ কামরার ভেতর থেকে ডাক দিয়ে বলেন যে যদি তাঁকে হত্যা করা হবে না—এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তাহলে তিনি বেরিয়ে আসবেন। তাঁকে নিশ্চিত করা হয়। তখন তিনি বেরিয়ে আসেন। তিনি বের হয়ে আসার পর হাবিলদার মেজর খান ওয়াজির, পরবর্তী সময়ে সুবেদার, তাঁর গালে একটা সশব্দ চড় মেরেছিল।

আমার ওপর আদেশ ছিল শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করার, কিন্তু তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে কিংবা কার কাছে হস্তান্তর করতে হবে, সেসব কিছুই বলা হয়নি। আমরা ফিরে যাওয়ার সময় আমি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি। শেষে ঠিক করলাম, তাঁকে ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি ভবনে নিয়ে গিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ওখানেই রেখে দেব। আমি জাতীয় পরিষদ ভবনের সামনে গিয়ে থামি। তারপর শেখ মুজিবসহ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাই। সেখানে ল্যান্ডিংয়ে বসাই তাঁকে। আমরা যখন এসব করছিলাম, তখন ফার্মগেটের দিকে হাজার হাজার লোকের ছোটার শব্দ পেলাম। আমরা ভাবি, ওরা আমাদের দিকে আসছে। তাই নিজেদের রক্ষার জন্য প্রস্তুত হই আমরা। কিছুক্ষণ পর শব্দটা মিলিয়ে যায়। জাতীয় পরিষদ ভবন থেকে আমি মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারে যাই। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ওখানে তাঁর প্রধান দপ্তর বানিয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার গোলাম জিলানি খানের সঙ্গে দেখা করলাম আমি। তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁকে জানালাম শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি বিল্ডিংয়ে রেখে এসেছি। তিনি আমাকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের অফিসে ঢোকার মুখ পর্যন্ত নিয়ে যান।

তারপর ভেতরে গিয়ে জেনারেলের কাছে রিপোর্ট করতে বলেন। জেনারেল টিক্কা নিশ্চয়ই জেনেছেন শেখ মুজিবকে বন্দী করা হয়েছে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—এই মর্মে আমার আনুষ্ঠানিক খবরটার জন্য খুব শান্ত হয়ে বসে তিনি অপেক্ষা করছিলেন। একটু মজা করার জন্য আমি তাঁকে বলি, একজন লোককে গ্রেপ্তার করেছি, যিনি দেখতে শেখ মুজিবের মতো; আমার মনে হয় এ লোকটাই শেখ মুজিব। তবে আমি নিশ্চিত নই। এটা শোনামাত্র জেনারেল টিক্কা বাক্সের ভেতর স্প্রিং লাগানো পুতুলের মতো তাঁর চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তারপর ব্রিগেডিয়ার জিলানিকে ডাক দেন। তিনি অফিসে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে আমি কী বলেছি, তা শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি এক্ষুনি ব্যাপারটা দেখছেন বলে কমান্ডারকে আশ্বস্ত করেন। কর্নেল এস ডি আহমদকে ডেকে এনে তাঁকে জাতীয় পরিষদ ভবনে গিয়ে দেখে আসতে বলা হলো আমি আসল না নকল শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছি। কর্নেল এস ডি আহমদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সিগারেট খাওয়ার জন্য আমি অফিস বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে দাঁড়াই। আমি যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম, হেডকোয়ার্টারের সীমানার কাঁটাতারের কাছে বসানো একটা হালকা মেশিনগান থেকে একপশলা গুলি বর্ষিত হয়। ওটা দুর্ঘটনাবশতও হতে পারে অথবা গানার কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল। গুলিবর্ষণের পর কিছুক্ষণের জন্য আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। তারপর ক্যান্টনমেন্টের এবং শহরের সব কটি অস্ত্র একসঙ্গে গুলিবর্ষণ শুরু করে। অন্যদের থেকে পিছিয়ে না থাকার জন্য এয়ারফিল্ডের অ্যান্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্টও গোলাবর্ষণ করে।

সবুজ আর হলুদ আলোর ধনুকাকৃতির রেখা পুরো ঢাকা শহরের ওপর আঁকিবুঁকি করতে থাকে। কয়েক মিনিট পর যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবে হঠাৎ করে সব থেমে যায়। মিনিট বিশেক পর কর্নেল এস ডি আহমদ ফিরে এসে নিশ্চিত করেন যে আমি আসল শেখ মুজিবকেই গ্রেপ্তার করেছি। তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে, এ কথা জিজ্ঞেস করলে তাঁরা একত্রে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। কারণ, আগে তাঁরা এ বিষয়ে কিছুই ভাবেননি। সবশেষে ঠিক হয় যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে যে কামরায় রাখা হয়েছিল, সে কামরাতেই রাখা হবে। আমরা তাঁকে ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসে নিয়ে যাই। তাঁকে সেখানে একটা আলাদা এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে রাখা হয়, সঙ্গে একজন গার্ড দেওয়া হয়। পরদিন মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হয়েছে? কোথায় রেখেছি বললে তিনি খুব বিরক্ত হলেন। বলেন, পরিস্থিতি উপলব্ধি করার বিষয়ে মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে। তাঁকে মুক্ত করার একটা চেষ্টা চালানো হতে পারে। তিনি পরে শেখ মুজিবকে একটা স্কুল বিল্ডিংয়ের তিনতলায় স্থানান্তরের নির্দেশ দেন।

অনুবাদ: ফারুক মঈনউদ্দীন

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।