নির্ভুল বার্তা ডেস্কঃ
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অবাস্তবায়নযোগ্য কাল্পনিক ও কাগুজে বাজেট ছাড়া আর কিছুই নয়। এক কথায় সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন হয়নি। করোনা মহামারি সংকট থেকে জনগণকে রক্ষায় দিকনির্দেশনাও নেই। বরং অর্থনীতির নানা তত্ত্ব ও বিশাল সংখ্যার আর্থিক উপস্থাপনার মাধ্যমে কার্যত জনগণের সঙ্গে এক ধরনের ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর অনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব মন্তব্য করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, করোনাভাইরাস মহামারিকালে মানুষের জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে এবং বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রস্তাবিত বাজেটের শব্দমালার মাঝেই বাজেটের ভাঁওতাবাজি পরিষ্কার। কারণ করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ১৮ মাস ধরে অচল। এরমধ্যে অপরিকল্পিত লকডাউনের নামে শাটডাউনে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষদের জীবন চূড়ান্ত রকমে থমকে গেছে। তাই সুস্পষ্টভাবে মানুষের জীবন-জীবিকার কথা মাথায় না রেখে শুধু অর্থনীতির নানা তত্ত্ব ও বিশাল সংখ্যার আর্থিক উপস্থাপনার মাধ্যমে কার্যত জনগণের সঙ্গে এক ধরনের ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা এ বাজেটেও স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অথচ এ মুহূর্তে মানুষের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, জনগণের কাছে এ সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এজন্য যারা (সংখ্যা বেশি) দিন আনে দিন খায় তাদের খুশি করার কোনো দরকার নেই। যাদের খুশি করলে দুর্নীতি বহাল থাকবে, দুর্নীতি করতে পারবে সেটাই তারা করছে। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাজেট হয়েছে। সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের অর্থনীতি এ বাজেটে অনুপস্থিত।
বৈষম্যহীন, জনবান্ধব, কল্যাণমুখী ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই দেশে ‘জনআকাঙ্ক্ষার’ বাজেট প্রণয়ন সম্ভব বলে মনে করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, করোনা মহামারির সংকট থেকে জনগণকে রক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ‘মানুষের’ জন্য নাকি বাজেট দেওয়া হয়েছে। শুনতে ভালো শোনায়। কিন্তু বাজেটে দিন আনে দিন খায় এমন জীবন-জীবিকা রক্ষার নগদ অর্থের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই। এখানে পুরাতন ত্রুটিপূর্ণ ব্যাংক নির্ভর ঋণের কথাই বলা হয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, এ বাজেটে হতদরিদ্র ও শ্রমিকদের প্রত্যাশিত প্রণোদনা উপেক্ষিত হয়েছে। অনেক দেশে প্রণোদনার বরাদ্দ ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে সরকারের বরাদ্দ ২ শতাংশের নিচে। এটা লোক দেখানো প্রণোদনা। সামাজিক নিরাপত্তা খাত সম্প্রসারণের নামে যে সামান্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। মধ্যবিত্তদের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো ঘোষণাও দেওয়া হয়নি। এতে মধ্যবিত্তকে হতাশ করেছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বেকার ও শহর থেকে গ্রামে চলে যাওয়া মানুষজন ও প্রবাসীদের সহায়তা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিএনপি মহাসচিব। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাত নিয়ে এত কথা বলা হলেও এ খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যেই আছে। এটা খুবই দুঃখের কথা। এ বরাদ্দ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের চাহিদা মিটবে না। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। করোনার টিকা প্রদানের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। মাসে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা বলেছে সরকার। সেটা কবে থেকে কাযর্কর হবে, কিভাবে হবে- সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা হয়নি।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা বলে, কিন্তু বরাদ্দে তার প্রতিফলন নেই। করোনার ক্ষত থেকে শিক্ষা খাত পুনরুদ্ধারে কোনো প্রণোদনা নেই। বরং প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি স্ববিরোধিতা। সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা বললেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানের ওপর ট্যাক্স আরোপ করে মূলত শিক্ষা সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা শুরু করে বিএনপি উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটানোর সুযোগ করে দিয়েছিল।
এসএমই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান এ খাতে। কিন্তু সরকারের প্রণোদনা পেয়েছে মূলত বড় শিল্পমালিকরা। মুদ্রাস্ফীতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক আগেই মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। এপ্রিলে গড়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এবারের বাজেটে তা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ ধরা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবভিত্তিক নয়। বাজেটে মৎস্য চাষ খাতে প্রস্তাবিত কর বাতিল এবং ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের আয়সীমা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধির দাবি জানান তিনি।
করপোরেট ছাড় প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, করপোরেট করহার কমানো হয়েছে, ব্যবসায়িক টার্নওভার করহারও কমেছে। অর্থমন্ত্রী দুই হাত ভরে দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের। তিনি নিজেও ব্যবসায়ী। বাজেটে হতাশ মধ্যবিত্তরা, খুশি ব্যবসায়ী মহল। বাজেটে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানের আমদানিতে আগাম কর (আগাম ভ্যাট) কমানো হয়েছে। সময়মতো ভ্যাট রিটার্ন না দিলে জরিমানার পরিমাণ কমানো হয়েছে। ভ্যাটের টাকার ওপর সুদের হারও কমানো হয়েছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা সব সুযোগ নিচ্ছেন এ বাজেটে।
বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, করজাল সম্প্রসারণে বাড়ির নকশা অনুমোদন ও সমবায় সমিতির নিবন্ধনে টিআইএন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এর অর্থ শহর বা গ্রামে যেখানেই কেউ বাড়ি করতে যাবে তাকে টিআইএন নিতে হবে। বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের নিয়ে সমবায় সমিতি করে সেটির নিবন্ধন নিতে গেলে টিআইএন লাগবে। এর ফলে বাড়ির মালিক ও সমবায় সমিতিগুলো করজালের আওতায় আসবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বড় আকারের বাজেট আর বড় অঙ্কের প্রবৃদ্ধির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উচ্চাভিলাষ তিনি বজায় রেখেছেন। এবার সবাই আশা করেছিল জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সরকার সাধারণ মানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়ার দিকে বেশি নজর দেবে। এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি ।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ শামসুল আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন নসু, চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।